(১)
মাঝ রাতে মোবাইলটা বেজে উঠলো। থমথমে অন্ধকার রাত। মোবাইলের শব্দে রাতের স্তব্ধতা কাঁচের ন্যায় ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা ভয়ানক বুকফাটা আর্তনাদের ¯্রােত আমার কানে আছড়ে পড়ল।
-“মামুন, আমি এতিম হইয়া গেলামরে মামুন! মায় আর নাইরে ভাই। আমারে ফালাইয়া কইজানি গেলগা!”
আমি বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইলাম। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর্তনাদের স্বরটা আমার কোন স্বপ্ন কিনা বুঝার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু একমুহুর্ত পরেই আবার সেই আর্তচিৎকার- “তুই আইবিনা মামুন! মায়রে একবার শেষদেখা দেখবি না? মামুন কথা কস না ক্যান ভাই! মামুনরে!”
এবার আমার ঘুমের ঘোর কেটে গেল। সমস্ত দুনিয়াটা যেন থমকে গেল। রতনদা কি বলল- মা নেই! মা চলে গেছেন মানে? মা কি তাহলে মারা গেছেন! আমার মা- তারপর একটা চিৎকার- মাগো! সমস্ত আকাশটা যেন মাথার উপর গুড়িয়ে গেল।
নিচের রুমে ড্রাইভার থাকে। আমার চিৎকারে ছুটে এলো রহমত মিয়া। আমার রহমত ভাই।
-“স্যার, ও স্যার, কি হইল আফনের?”
আমি উত্তর দেবার অবস্থায় নেই। কেমন একটা অনুভব, যেন নেশার চরম ঘোর! রহমত ভাই উত্তরের অপেক্ষা না করে আমার হাতে থাকা মোবাইলটা নিজের কানে ধরল। রতনদার কলটা তখনও কাটেনি। রহমত ভাই ফোন কানে ধরে খানিক্ষণ চুপ করে থাকল। এরপর ফোনটা নামিয়ে বলল- “স্যার, আফনে তৈয়ার হন। আমি গাড়ি বার করতাছি।”
(২)
আমি হলাম দরিদ্র এক মুসলমানের ছেলে। কিন্তু আমার কোনদিন কোন অভাব ছিলনা। ছয় বছর বয়সে এই এলাকায় এক ভয়ানক কলেরার প্রকোপ দেখা দেয়। আমার মাঝ বয়সি আব্বা যখন কলেরায় মারা যায়, হিন্দুপাড়ায় ঘর বলে সমাজের একটা মানুষও আসল না। অভাগিনী আম্মা আমার আব্বার সেবা করতে করতে কখন যে নিজেও রোগ বাঁধিয়ে নিলেন। তারপর নিভৃতে চলে গেলেন। মরা মায়ের শিয়রে বসে আমি যখন কাঁদছিলাম তখন এই হিন্দু বিধবা মা’ই আমাকে নিজের কোলে তুলে নিয়েছিলেন। রতনদা আর আমাকে; দুজনকেই স্নেহ দিলেন, মমতা দিলেন।
দু’মাইল দূরের একটা মাদ্রাসায় পড়তাম। হিন্দুর ঘরে থাকি-খাই বলে কতজন কত কথা বলত কিন্তু কেউ কখনো নিজের ঘরে থাকতে দেয়নি। তাই এমন সমাজের কথায় আমি কখনো কষ্ট পাইনি। নিজেকে নিজের মত করেই গড়ে তুলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করে যখন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছি তখন মাকে ফোন দিলে মা বলত- “মন দিয়ে চাকরির পরীক্ষাগুলো দিও বাবা। আর কিছু লাগলে আমারে জানাইও।”
জানিয়েছিলাম। ঘুষের টাকার কথা। আমার প্রয়োজন শুনে নীরব ছিলেন মা। কয়েকদিন পওে কোত্থেকে যেন টাকার জোগাড় করে পাঠিয়ে দিলেন রতনদাকে দিয়ে। প্রথম মাসের বেতনটা যখন মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম তখন মায়ের মুখের কি স্বর্গীয় হাসি! যেন বেহেস্তের সেই অপরূপ সৌন্দর্য্য আমার মায়ের মুখেই। চাকরির বয়স এক বছরও হয়নি অথচ মা চলে গেলেন!
বেলা বারোটা নাগাদ গ্রামে পৌঁছলাম। উঠানে মানুষ ভেঙ্গে পড়ছে! আমাকে দেখেই রতনদা দৌড়ে এলো। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কওে কেঁদে উঠল। আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে পা-দুটো ধরে নির্বাক হয়ে রইলাম। মা কেমন শান্তিতে ঘুমায়! বেঁচে থাকতে এত শান্তি কোথায় পাওয়া যায়!
ততক্ষণে মায়ের মুখাগ্নির সময় হয়ে এসেছে। শ্মশান ঘাটে চন্দন কাঠের চিতায় মাকে শুইয়ে দিল সকলে। বাড়ির দক্ষিণের কোণায় আমি একটা চন্দন গাছ লাগিয়েছিলাম। সেই কাঠের বিছানায় মায়ের শেষকৃত্য! কোনদিনতো এমনটা ভাবিনি। রতনদা একলা আগুন দিতে গেল না। আমাকেও সাথে নিল। আগুন দিতে যাবো এমন সময় পেছন থেকে রহমত ভাই ডাক দিল- “স্যার, আফনের মায়ের জন্য এই যে শাড়িটা কিনছিলেন, এইটা কি করবেন?” আমি উত্তর দিলাম- “আমার রোজগারের টাকায় কেনা শাড়ি, আমার মা ঠিক পড়বে!”
মায়ের চিতায় শাড়িটা রেখে আকশের দিকে তাকিয়ে আগুন ছুঁইয়ে দিলাম। চোখ থেকে যে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তাতে যে আগুন নিভে না!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নক্ষত্রের রাত
অসাম্প্রদায়িকতার চমৎকার দৃষ্টান্ত , গভীর মমত্ববোধ, মায়ের অতুলনীয় ভালোবাসা সব কিছু যেন এক সাথে গেথে রয়েছে গল্পটিতে। বিশেষ করে শেষ লাইনটি অনেক বেশি হৃদয় ছুয়ে গেল। অসাধারণ ????
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।